ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল দাবিতে ক্লাসবর্জনসহ দিনভর আন্দোলন করেছে ঢাবি শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্দোলন দমন করতে ছাত্রলীগকে ডেকে আনেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগ আন্দোলনরত ছাত্রদের মারধর, ছাত্রীদের উত্যক্ত ও শ্লীলতাহানি করার মাধ্যমে আন্দোলনরতদের প্রতিহত করে। ঘটনাস্থলে তথ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকেও লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ। গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে এসব ঘটনা ঘটে।
সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে সোমবার কয়েক শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সকাল সাড়ে আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমবেত হয়। এর আগের দুই দিনও তারা একই দাবিতে বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধ করে। আন্দোলনরতরা প্রায় আড়াই ঘন্টা অবস্থান করে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ের কাছে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে তারা অধিভুক্ত সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানকে তাদের সঙ্গে এসে কথা বলার আহ্বান জানায়। কিন্তু তাদের অবস্থানের ৪০ মিনিট অতিক্রম করার পরও উপাচার্য তাদের সঙ্গে কথা বলতে আসেননি।
পরে ঘটনাস্থলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ছাত্রলীগের ঢাবি শাখা সভাপতি আবিদ আল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সসহ কয়েকটি হলের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত হন। আবিদ আল হাসান ও মোতাহার হোসেন প্রিন্স আন্দোলনরতদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার আহ্বান জানান। বক্তব্য দিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান।
সেখানে প্রায় ১০ মিনিট সাক্ষাত শেষে আবিদ আল হাসান আন্দোলনরতদের কাছে এসে পাঁচজন প্রতিনিধিকে উপাচার্যের কাছে গিয়ে তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরার জন্য বলেন। কিন্তু আন্দোলনরতরা সবাই প্রতিনিধি উল্লেখ করে উপাচার্য এর কার্যালয়ে যেয়ে সাক্ষাত করতে রাজী হয়নি। তারা উপাচার্যকে তাদের সামনে এসে কথা বলার অনুরোধ জানান।
পরে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ আবার উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ছাত্রলীগের ঢাবি শাখা সভাপতি আবিদ আল হাসান ও মোতাহার হোসেন প্রিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে হল থেকে তাদের নেতা-কর্মীদের ডেকে আনার নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুসারে দশ মিনিটের মধ্যে প্রত্যেক হল থেকে দলে দলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এসে আন্দোলনরতদের ঘিরে ফেলে।
ঘটনাস্থলে সরেজমিনে উপস্থিত থেকে দেখা যায়, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত মেয়েদের দিকে সিগারেটের ধুয়া নিক্ষেপ করে। তারা অঙ্গভঙ্গি এবং কথার দ্বারা আন্দোলনরত মেয়েদেরকে উত্যক্ত করে। ঘটনার দৃশ্য ধারণ করতে গেলে এনটিভি অনলাইন এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় বঙ্গবন্ধু হলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমানের অনুসারীরা। এ সময় রোকেয়া হলের সভাপতি লিপি আক্তার, কুয়েক মৈত্রী হলের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবন্তী শায়লা সাংবাদিকের দিকে তেড়ে আসেন। অবস্থান কর্মসূচি থেকে বঙ্গবন্ধু হলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন ও তার অনুসারীরা আন্দোলনরতদের অন্যতম উদ্যোক্তা মশিউর রহমান সাদিককে মুখ চেপে ধরে মারতে মারতে ভিসি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন তার সঙ্গে কথা বলেন। এই ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী এবং কয়েকজন সহকারী প্রক্টর অন্য কক্ষে অবস্থান নেন। পরে আন্দোলনরতরা একে একে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার ও আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র মশিউর রহমান সাদিক বলেন, আমরা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলে ছাত্রলীগ দিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে এটা আমার জন্য খুবই দুঃখজনক।
ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ডেকে এনে আন্দোলন প্রতিহতের বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে সবাই আসে। আমরা ঘটনার সমাধান করতে এসেছিলাম।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, তারা আসছিলো ঘটনার বিষয়ে জানতে। তাদেরকে ছাত্রলীগ বলা সমীচীন নয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সার্বিক ঘটনার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, আমি পূর্বেই বলে দিয়েছি সাত কলেজের কোনো কার্যক্রম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হবে না। তার পরেও তারা যা করেছে সেটা করার দরকার ছিলো না।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এই সাত কলেজের পরীক্ষার কিছু কার্যক্রম এবার ঢাবি ক্যাম্পাসে হয়। এতে ঢাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোগাান্তিতে পড়তে হয়। এর জের ধরে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে।