সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলায় হাওর বাঁধ নির্মানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। অধিক বরাদ্ধ পাওয়া সত্ত্বেও বাঁধকে ঘিরে কয়েকটি সিন্ডিকেট বানিজ্য সক্রিয় হয়ে উঠছে। সিন্ডিকেট নির্ভর অনিয়মিত, পিআইসিতে দলীয় করণ, আত্মীয় করন সহ বাঁধ বানিজ্যের অবাধ অপতৎপরতা এখন হাওর অঞ্চল জুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে জনসম্মুখে এসেছে।
উপজেলার হাওর গুলোতে এবছর ১শত পিআইসি রয়েছে। এর মধ্যে বেহেলী ইউনিয়নের হাওর এলাকায় ৫২টি, ফেনারবাঁক ইউনিয়নে ৩৫টি, জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নে ৫টি, সদর ইউনিয়নে ১টি, ভীমখালী ইউনিয়নে ৪টি, সাচনা বাজার ইউনিয়নে ৩টি।
১শত পিআইসিতে চুড়ান্ত প্রাক্কলনে বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে ১৭ কোটি টাকার অধিক।কিছু কিছু প্রকল্পে প্রাথমিক প্রাক্কলনের দেড় দুইগুণ বরাদ্ধ বাড়ানো হয়েছে।এতে সরকারের অর্থ অপচয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কাজ দ্রুততর করতে হাওরে নেমেছে প্রায় অর্ধশতক এক্সোভেটরের সাথে দুই ডজন ড্রামট্রাক।
বাঁধ নির্মানে ধীরগতি ও কাজের ক্ষেত্রে পাউবোর নীতিমালার যথাযথ অনুসরণ না করায় গত বছর অকাল বন্যায় কৃষকের স্বপ্ন ভূ-লুণ্ঠিত হয়েছে। অভাব তাড়িত কৃষকদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
পাউবো নীতিমালা উপেক্ষা করে বাঁধ বানিজ্যের হোতা প্রভাবশালীদের পছন্দের ও অনুগত কৃষক নামধারী ব্যাক্তিদের পিআইসিতে প্রত্যক্ষ করে পরোক্ষ ভাবে অন্তড়ালে থেকেই চলছে বাঁধের সকল কাজের নিয়ন্ত্রণ। উপজেলা নির্বাহি অফিসার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন কাজের অগ্রগতির জন্য।
এতে সাধারণ কারো বলার বা করার কিছুই নেই। বাঁধ বানিজ্যে এবার নতুন সংযোজন হল এক্সোভেটর ও ড্রামট্রাক সিন্ডিকেট।অন্য এক্সোভেটর আসতে না দেওয়ায় এক্সোভেটর সংকট রয়েছে।যার কারনে অনেক পিআইসি কাজ শুরু করতে পারছেন না।
কৃষকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরজমিনে হাওর বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রতিদিন কোন না কোন বাঁধে গিয়ে পিআইসিদের অনিয়মের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা গেছে। গুটিকয়েক বাঁধ ছাড়া অধিকাংশ বাঁধেই পাউবো নীতিমালার তোয়াক্কা করছেন না পিআইসিরা। যে কারনে গত বছরে আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত ঠিকাদারী ব্যাবহার সাথে এ বছরের পিআইসি ব্যবহার তেমন কোন পার্থক্যই দেখা যাচ্ছে না। বাঁধ নির্মানে হাওরে কেবল সিষ্টেম বদলেছে তবে চরিত্র বদলায়নি। কোন কোন বাঁধে গিয়ে পিআইসির লোকদের পাওয়া যায় না। বেতনধারী লোক দিয়ে বাঁধে মাটি ফেলার কাজ চালাচ্ছেন এহনও জনগুরুত্বপূর্ণ হাওর রক্ষা বাধঁ পিআইসিরা। অনেক বাঁধেই মাটিতে জম্মানো ঘাস বন আবর্জনা পরিস্কার না করেই মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে। বাঁধে কোথাও দেয়া হচ্ছে কাদাভেজা-বালুমাটি আবার কোন বাঁধেই নিয়ম মাফিক দুরমুজ না করায় মাটির ভেতরের অংশ ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। আবার কোন কোন বাঁধের গোড়া থেকে মাটি উত্তোলন করে ঐ বাঁধেই ফেলা হচ্ছে। এতে করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধের বাঁধ দূর্বল ও ঝুকিপূর্ণ থেকে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকরা আশংকা করছেন যে সব বাঁধের কাজ ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশী সম্পন্ন হয়ে গেছে, সে ভাবেই পুরো কাজ সম্পন্ন করলে ত্রুটিপূর্ণ এসব বাঁধে চৈত্র -বৈশাখ মাসের ভারী বর্ষণেই ফাটল ধরে ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর বাঁধের লাগোয়া নদীর স্রোতের তোড়ে ভেঙ্গে হাওরে পানি ঢুকে ফসল তলিয়েছে। এরকম অনেক বাঁধ বালিমাটি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে। অথবা নীচে স্ত্তুপাকৃত বালির স্তরের উপরেই মাটি ফেলে বাঁধের কাজ সারিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যে কারনে এ সকল বাঁধ এবারো ঝুকিপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। অনেক পিআইসি সবেমাত্র বাঁধের কাজ আরম্ভ করছেন। দেরীতে শুরু করা এইসব বাঁধের কাজ চলতি ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন করা সম্বব হবে না।
বেহেলী ইউনিয়নের হালির হাওর এলাকায় ১৫নং পিআইসির সভাপতি পেমানন্দ দাসের পরিবর্তে তার ভাই উপানন্দ দাস বাঁধের কাজ দেখভাল করছেন। এ বাঁধে দুরমুজ ও সাইডে ঘাসবন লাগানো হয়নি। উপানন্দ দাসের সাথে পাউবোর কর্মকর্তা নিহার রঞ্জন দাসের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। যে কারনে পিআইসিতে উপানন্দ দাসের নাম থাকায় সমালোচনার মুখে তার আপন ভাই পেমানন্দ দাসের নাম পিআইসি সভাপতি হিসাবে তালিকা ভূক্তি করেন। তবে নামে পেমানন্দ দাস হলেও ঐ প্রকল্পে উপানন্দ দাস প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৪ নং পিআইসি সভাপতি আব্দুল মতিন বাঁধের কাজে নিয়মিত না থেকে বেতনধারী লোকদিয়ে কাজ করাচ্ছে। বাঁধে কাদামাটি ঘাস বন আবর্জনার উপর মাটি ফেলছেন। একসাথে উচু করে মাটি ফেলায় ২ফুট অন্তর অন্তর দুরমুজ করছেন না।
৫৮নং পিআইসি রফিকুল ইসলাম বাঁধের গোড়া থেকে এক্সোভেটর দিয়ে মাটি উত্তোলন করে বাঁধে ফেলছেন। ঝুকিপূর্ণ এই বাঁধেও দুরমুজ হয়নি।
এদিকে হালির হাওরের সবচেয়ে বিপদ জনক কালীবাড়ি ক্লোজার বাঁধ। এই বাঁধে এবছর ৪টি পিআইসির মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। গত বছর এই বাঁধটি ভেঙ্গে হালির হাওর তলিয়ে যায়, তখন বাঁধের দায়িত্বে ছিলেন বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান অসীম তালুকদার। গত বছরের বালি বাঁধের গোড়ায় বালির স্তর স্তুপাকৃত রয়েছে। জমাকৃত এই বালির উপর মাটি ফেলে বাঁধের কাজ সারছেন এবারের পিআইসিরা। ঝুকিপূর্ণ এই বাঁধ এভাবে বাঁধলে এবারো ভাঙ্গার সম্বাবনা রয়েছে বলে এলাকাবাসী জানান।
৬০নং পিআইসি সভাপতি জানকি নাথ কে পরিবর্তন করে এই প্রকল্প এলাকা থেকে দূরবর্তী ৯নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য অজিত রায়কে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, অজিত রায় নিয়মিত বাঁধের কাজে আসেন না। তার বাড়ী দূরবর্তী হওয়ায় প্রকল্পের কাজ হাওর মামলার আসামী বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান অসীম তালুকদার নিজেই চালিয়ে যাচ্ছেন। চেয়ারম্যান নিজে অনেকটা চুপিসারে শ্রমিকের বেতন সহ প্রকল্পে দেখভাল করছেন।যদিও এখনও এই বাঁধে মাটির কাজ শুরু হয়নি। এছাড়াও চেয়ারম্যান অসীম এবারও হাওরের বেশ কয়েকটি পিআইসি নিজস্ব লোক দিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছেন বলে জনমুখে আলোচনা রয়েছে। বেহেলী ইউনিয় পরিষদ চেয়ারম্যান অসীম তালুকদারের মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেন নি।
পাউবোর জামালগঞ্জে দায়িত্ব প্রাপ্ত উপ-সহকারি কর্মকর্তা নিহার রঞ্জন দাস বলেন, কোন পিআইসির সাথে আমার অন্য রকম সম্পর্ক নেই। তবে পেমানন্দ দাস সম্পর্কে আমার শশুর হন। পিআইসিদের কাছ থেকে সঠিক ভাবে কাজ আদায় করিয়ে নিতে সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো:শামীম আল ইমরান বলেন, বাঁধের কাজে কোন প্রকার অনিয়ম-গাফলতি হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এ ব্যাপারে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।