শীতে গ্রামবাংলার চাষীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎসবের প্রধান খেজুর রস।
ডুমুরিয়া, খুলনা প্রতিনিধি।
ডুমুরিয়া ( খুলনা)খেজুর রস শীত কালে প্রামীণ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় যেন এক গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান। স্বপ্ন ও প্রত্যাশায়
অনেক খানি খেজুর পাছের সঙ্গে চাষীদের আঙ্গাঅ্গি ভাবেই বসবাস হয়ে উঠে। নানা ভাবে জড়িত চাষীর জীবন
সংগ্রামে অনেক কষ্টের মাঝে অনেক প্রাপ্তি হয় হয় বাংলার এমন জনপ্রিয় তরুবৃক্ষ খেজুর গাছের সঙ্গে।
ভূমিহীন চাষী প্রান্তিক চাষী দায়িত্ব ফ্রিস্ট মানুষের জন্যই যেন এমন সময়টা অনেক আনন্দদায়ক। কারণ,
এমন খেজুর পাই তারে চাষী অন্নদাতা।
জানা যাক, হেমন্তের শেষেই শীতের ঠান্ডা পরশে গ্রামবাংলার হরেক রকমের চাষী খেজুর গাছের মিষ্টি রসে
নিজকে নেওয়ার করে শীতকা
নিজকে ডুবিয়ে নেওয়ায় সুন্দর মাধ্যম সৃষ্টি করে। আবহমান গ্রামবাংলার চাষীদের যেন একঘেয়েমির যান্ত্রিকতায়
জীবনযাপনের অনেক পরিবর্তন আনে শীতকালের ঋতুচক্র। শীতকালে বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রামীণ সংস্কৃতির মাঝেই
যেই খেজুর রসের পিঠা শৈল্পীক ঐতিহ্যের বহুমুখী সমারোহ কিবা প্রাণোচ্ছলতায় বারবারই ফিরে আসে।
তাদের খেজুর গাছের যত্ন-আত্তি না করলে যে রস মিলবে না। আর রস না মিললে গুড় হবে কি করে। পাটালি
না দেখলে যেন ঘুম আসে না চাষীর। চাধী তাদের মেয়ে বা বউয়ের হাতের কাঁচা সুপারির কচি পান গালে ভরে
বাশের ডালি মাথায় করে পঞ্জে বা দূর্বতী হাটে যাবেই বা কি করে। পাটালি গুড়ের মিষটিমধুর গপে চাষীরা বিক্রয়
কাজে না থাকলে পেটে ভাতে বাঁচবে কি করে। শীত আমেজে প্রকৃতির মাঝ হতে সংগীহিত খেজুর রস চাষীরা
যেন চষে বেড়ায় সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যায় মেঠো পথ ধরে, তারই বহিঃপ্রকাশে যেন চমৎকার নান্দনিকতা এবং
অপরূপ দৃশ্য অনুভব করে, তা যেন অবশ্যই এক শৈল্পীকতার নিদর্শন। এমন শৈল্পীক আস্থা ও বিশ্বাসকে নিয়ে
প্রকৃতির মাঝে বিশাল আকৃতির এক কুয়াশা চাদরে মুড়ি দিতে হয়। এই শীতেকালে রূপ সৌন্দর্যের আর একটি
উপাদেয় সামগ্রী খাঁটি শরিয়া তেল, যা শরীরে মালিশ করে অনেকাংশেই ত্বকের মশ্রিণতা এবং ঠান্ডা দূর করে
খেজুর গাছে উঠতে। গ্রামে খুব ভােরে খেজুর গাছ হতে রসের হাড়ি নামিয়ে আনতে ব্যস্ত হল চাষী। রাতের এ
হিমশীতল রস ভােরে হাড় কাঁপানি ঠান্ডায় গাছ থেকে নামিয়ে খাওয়ার যে স্বাদ তা একেবারেই যেন খুব আলাদা।
আসলে ভোর বেলায় রস খেলে শীত আরাে অনেক জাঁকিয়ে বসে। আবার শীতে শরীর কাঁপানির এক স্পন্দন
যে চরম মজা দায়ক। শীত লাগে লাগুক না কেন, তবুও রস খাওয়ার কোন বিরাম নেই। এক গ্লাস, দুই গ্লাস
খাওয়ার পরপরই কাঁপতে কাঁপতে যেন আরও এক গ্লাস মুড়ি মিশিয়ে মুখে তুলে চুমক দেয় আর রােদ পােহানাে
সে যে কি আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা দূরহ। এই শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে গ্রামের ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে
খুব ভােরে উঠে হাত মুখ ধুয়ে খড় কুটোয় আগুন জ্বেলে হাত পা গরম করে এবং অপেক্ষা করে কখন রােদের
তেজ প্রখর হবে। তাদের রােদ পােহানাের আরামের সঙ্গে আরও অপেক্ষা, তা হলে তাদের প্রিয় খেজুর রস।
কখন যে আসে আর তখনই খাবে। সে রস আসলে যথা সময়ে হাজির হলে তাদের কাছে যেন আনন্দ উল্লাসের
কোনই কমতি হয়না। গ্রামবাংলার অডাবী মেয়েরা রংবে রংয়ের যেসব খেজুর পাতায় খেজুর পাটি তৈরী করে
তার উপরই যেন চলে রস খাওয়ার আসর। উপার্যনের জন্যই খেজুর পাতা শুকিয়ে তা দিয়ে খেজুর পাটি তৈরী
পর বিক্রয় করে সংসারের কিছুটা অর্থ সংকোলান হয়। সুতরাং এই খেজুরের পাটিতেই গ্রামের অনেক পরিবার
ঘুমানাে কাজে তা ব্যবহার করে। খেজুর পাতায় এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুরের পাতা, ডাল।
এবং পাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আর মােরুব্বা তৈরিতেও খেজুর কাটার ব্যবহার প্রচলিত
আছে। এক কথায় বলা চলে খেজুর গাছের পাতার ও ডাল সেতাে কবর পর্যন্ত চলে যায়’ ই হয় সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত রস দেয়। গাছ
৯ গেলে রস কমে যায়। আর পুরনাে খেজুর গাছের রস খুব মিষ্টি হয়। মাঝ বয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে
বেশি রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা পাছের জন্য অবার অনেক ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্য কাতিক
মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। কার্তিক মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফান মাস
পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও
তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসের ভর মৌসুম। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্তুন মাস পর্যন্ত একটি
খেজুর গাছে মাসে ৪০ কেজি রস পাওয়া যেতে পাবে। খেজুর গাছ শুধু রস দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। শুকনাে খেজুরে
ভেষজ গুন অনেক রয়েছে, খেজুরের বীজগুলাে বাহির করে নিয়ে দুধে খেজুর গুলাে মিশিয়ে ভাল ভাবে ফুটিয়ে
গরম করে এই দুধ, খেজুর ঠান্ডা করে শিশুকে খাওয়ালে শক্তি বাড়ে। আবার একটি শুকনাে খেজুরের ফলের
পুষ্টি মান তুলে ধরে বলা যায়, প্রায় ৭৫-৮০% শর্করা, ২% আমিষ এবং প্রায় ২.৫% স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকে।
১০০ গ্রাম শীসে ২০ ভাগ পানি, ৬০-৬৫ ভাগ শর্করা, ২ ভাগ আমিষ এবং খুব সামান্য কপার, সালফার,
ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ, বি-১, বি-২ এবং খনিজ লবণ খোঁজে পাওয়া যায়।
চাষীরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান এ গাছে থেকে সে গাছে। মাটিতে পা ফেলার ফুরসতটুকুও পায় না
অভাবী এই মানুষ গুলাে। শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ তােলার জন্য অনেক আগে থেকেই সকাল-সন্ধ্যায়
যেন লেগে থাকে চাষী। খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। আর এই গাছ গুলাে কাটে যারা তাদেরকে
পাছি বলা হয়। তারা বিভিন্ন উপকরণ সমন্বয়ে গাছি নাম ধারি মানুষ পরিচ্ছন্ন ভাবে গাছ কাটার জন্য ব্যস্ত
হয়ে যান। তারা গাছ কাটতে ব্যবহার করেন দা, দড়ি, এক টুকরাে চামড়া বা পুরনো বস্তা আবার দা রাখার জন্য
বাঁশ দিয়ে তৈরি থলি বা ঝাঁপি। সে ঝাঁপি গাছিরা রশি দিয়ে খুব যত্নে দা রেখে এ গাছ থেকে সে গাছে উঠা, নামা
করে সুবিধা পায়। আবার কোমরে বেশ কিছু চামড়া বা বস্তা বেঁধে নেয় যেন গাছে উঠা নামায় কোন প্রকার
সমস্যা না। গাছ কাটার জন্য গাছি শরীরের ভারসাম্য রক্ষার সময় কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়।
দড়িটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এই দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময়
গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যে গিঁট দুটি জুড়ে দিয়ে নিজের জন্য গাছে উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়।
রস জ্বাল দিতে যে পরিমাণ জ্বালানির প্রয়ােজন তা পাওয়া যায় না এমন আক্ষেপে চাষীর বউ ঝগড়া করলেও
চালের আটায় তৈরি ভাপা পিঠা খেজুরের গাঢ় রসে ভিজিয়ে খাওয়ার পর যেন সব রাগ মাটি হয়ে যায়। আবার
কখনও সখনও চাষীর বউকে এক প্রকার সান্তনা দিয়ে বলে অভাবের সংসারে যা আছে তা দিয়ে এ পেশা
চালালে বাঁচা যাবে কি করে। বছরে পাঁচ মাস ধরেই তাে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা হয় আর তা খড়কুটার
জ্বালানিতে গুড় বানিয়ে বাজারে বিক্রি হয় বলেই কোন মতে পেট চলছে। বউ আবার মুচকি হাসি দিয়েই বলে,
সংসার চলছে তাে ভালােই কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য ভাবাে কিছু। তার তাে বিয়ের বয়স হয়েছে, এমন কথাও
চলে আসে খেজুর গাছির ছােট্ট পরিবারের। চাষীর খেয়াল তাে আছে বৈকি তবে আরও পরিশ্রম ও কষ্ট করার
প্রয়ােজন হবে, সামনের শীতে চাষীর ইচ্ছা আরােও বেশ কিছু খেজুর গাছ বর্গা নিলেই মেয়ের বিয়ের কিছু টাকা
হাতে আসবে। এমন কথা সচরাচর শুনা যায় খেজুর চাষির কষ্টে। চাষির আদরের বিবাহিত মেয়ে জামাইকে
দাওয়াত দিয়ে খেজুর রসের পিঠা পায়েসের তৈরী আয়ােজনে চরম ধুম পড়ে। চাষীর মেয়ে, বউ ঝিয়েরা খেজুরের
রস বা গুড় তৈরিতে অত্যন্ত ব্যস্ত সকালের মনােরম পরিবেশে উপভােগ করে। এমন এক চমৎকার দৃশ্য বড়ই
শৈল্পিক উপাখ্যান। শুধুই কি তাই, শীতের এই সকালে রস বা পাটালি গুড় তৈরীতে জ্বালানীর পাশে বসে অথবাকি গুড় মিশিয়ে গল্পকণের মধ্যে গুড় জমাটি বাঁধতে শুরু করে। তখন এ গুড় মাটির হাঁড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির
পাত্রে রাখার প্রয়ােজন পড়ে। সে গুড় দেখলে বুঝা যাবে, একেবারে জমাটি বেঁধে পাত্র আকৃতি ধারণ করেছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাকলে বহুকাল ধরে পেশাদার খেজুর গাছ কাটিয়ে আছে। স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় পান্ছি।
কার্তিক মাসের শুরু হতে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত তারা খেজুর গাছ কাটায় নিয়োজিত থাকে। যেসব চাষির স্বল্প
সখ্যক খেজুর গাছ আছে নিজেরাই তারা তা কাট থাকে। তারাই রস পাড়ে ও বাড়িতে নিয়ে এসে জ্বাল দিয়ে
শুড় তৈরি করে। শীতের
সে রসের স্বাদ যেন বেশী হয়। এ রসকে জিরান কাট রস বলে, গন্ধে ও এ রস হয় সবচেয়ে উত্তয়। এই জিরান
কাট রস নামানাের পর আবারও রসের ভাঁড় বা কলস পাছে টাওালে তখন এই খেজুর গাছ হতে যে রস পাওয়া
যাবে ত উলাকাটা’ রস। প্রেম বাংলায় এই শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে যারা খেজুর বনের চাষ করে তারই
তে পভীব রাতে খেজুর রস নামিয়ে উনুনের আগুনে জ্বালাতে ব্যস্ত হয়। সত্যিই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর
বনের পাশে উচু ভিটায়। এমন নিবিড় শ্তলতার মধ্যেও যেন জীবন সংগ্রামে তাদের মজার স্পন্দন উপলব্ধি হয়।
উনননের পাশেই থাকে পাছি বা শ্রমিক মজুর, তাদের থাকবার জন্য বানায় কুঁড়ে ঘর, খেজুরের পাতা কিংবা
বিচালি দিয়ে ছাওয়া হয়। কান পাতলে শােনা যায়, পাছিয়া নিঃসঙ্গতা কাটাতে গ্রাম এলাকায় প্রচলিত বিভিন্ন
ধরনের পান পেয়ে থাকে। তাদের সুরে আছে অদ্ভুত প্রাণময়তা ও আবেগ, সহজেই হূদয়ে ছুয়ে যাওয়ার মতাে।
পত্রবৃত্তে আবৃত খেজুরের কাওটি সরল, গােলাকৃতি এবং ধূসর বর্ণের হয়। মাথায় মুকুটের মতাে ছড়ানাে পাতা
গুলাে উর্ধমুখী ও ছুরির ফলার মতাে তীক্ষ্ণ। খেজুরের ভিন্নবাসী পাছে স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল আলাদা ভাবেই
গাছে জন্মায়। খেজুর গাছের পুং পুষ্পমঞ্রী খাটো, চুল সাদা মোচার মত বা ঘিয়ে রঙের মতাে দেখতে হয়।
খেজুর গাছের পরিপক্ক এ ফুলের মােচায় বাকুনি দিলেই ধুলার মতাে পুরেণ বাহির হতে দেখা যায়। আবার স্ত্ী
পুষ্প মঞ্জরী লম্বা এবং ফুলের রং হালকা সবুজ হয়ে থাকে। স্ত্রী গাছে অজত্র ফল হয়ে থাকে তা অনেক উচ্জ্বল
দেখায়। একটা মজ্রীতে অনেক স্ত্রী ফুল ফোটে, যা থেকে একটি কাঁদি তৈরী হয়। খেজুর গাছের মাথায় খুব
সুচালাে অসংখ্য কাঁটার সমন্বয়ে ঝােপের মতো হয়ে সৃষ্টি এ গাছ। খেজুর গাছের পাতার গােড়ার দিকের প্রতিটি
পাতা কাঁটায় রূপান্তরিত হয়। সাধারনত এই পাতা ও মিটার লম্বা এবং নীচের দিকে বিশেষ করে বাঁকানাে হয়।
খেজুর পাছ সারা বছর একই রকমেই থাকে। পাকা ফল দেখতে পার্পেল-লাল রঙের এবং তা সুমিষ্ট হয়, খাওয়াও
যায়। পাখিদের প্রিয় এটি।
শীত কালে খেজুরের রস সবারই রসনা তৃপ্ত করে। আর খেজুর গাছের মাথার কচি অংশ তাে দারুন লাগে খেতে।
খেজুর গাছ ছয় সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। পচিশ থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত রস দেয়। পাছ
পুরনাে হয়ে পেলে রস কমে যায়। পুরনাে গাছের রস খুব মিষ্টি হয়। মাঝ বয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি রস
পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা পাছের জন্য ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা
শুরু হয়। কার্তিক মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস
ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ,
পৌষ, মাঘ মাস হলাে রসের ভর মৌসুম। একবার গাছ কাটার পর দুই তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের
রসকে বলে জিরান কাট। জিরান কাট রস খুবই সুস্বাদু। প্রথম দিনের রস থেকে ভালাে পাটালি গুড় তৈরি হয়।
দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে দোকাট। তৃতীয় দিনের রসকে বলে তেকাট। রসের জন্য গছি একবার কাটার পর
পাঁচ ছয় দিন পর আবার কাটা হয়। গাছের কাটা অংশ কালোর জন্য এসময় দেওয়া হয়। কাটা অংশ শুকানাের
সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলাে সরাসরি কাটা অংশটকপড়ে। রস পেতে হলে খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। যারা গাছ কাটে তাদের বলা হয় পাছি। গাছিদের
গাছ কাটার জন্য কয়েকটি উপকরণ দরকার হয়। যেমন-দা, দা রাখার জন্য একটি ঝাঁপি, দড়ি এবং এক টুকরাে
চামড়া বা পুরনাে বস্তা। গাছি যে ঝাঁপি ব্যবহার করে তা বাঁশ দিয়ে তৈরি। গাছে উঠার সময় পাছি এই ঝাঁপিতে
দা রাখে। কোমরে বেঁধে নেয় চামড়া বা বস্তা। গাছ কাটার সময় শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছি কোমর
বরাবর পাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এই দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায়
গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময় গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যে গিট দুটি জুড়ে দিয়ে নিজের জন্য পাছে।
উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়। গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে চেঁছে পরিষ্কার করা
হয়। কাটা অংশের নিচের দিকে দুটি খাঁজ কাটা হয়। খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা
হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলী বসানাে হয়। এই নলী বেয়ে হাড়িতে রস পড়ে। নলীর পাশে বাঁশের
তৈরি খিল বসানাে হয়। এই খিলে মাটির হাড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়। এই হাড়িতে রস জমা হয়।গাছ থেকে রস
সংগ্রহের জন্য মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। এই হাড়িকে বলে ভাঁড়। কোথাও বলে ঠিলা। ভাঁড় দেখতে ছােট
আকৃতির কলসের মতাে। খেজুর রস মাঝারি আকৃতির দশ থেকে পনেরাে ভীড় রস জ্বাল দিলে এক ভাড় গুড়
হয়। এই এক ভাঁড় গুড়ের ওজন হয় ছয় থেকে আট কেজির মতাে।খেজুরের রস হতে তৈরি গুড়। মিষ্টি জাতীয়
খাবার। বাংলাদেশে বেশ প্রসিদ্ধ। শীতকালে তৈরি হয় এবং সারা বছরই পাওয়া যায়। প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ
সমৃদ্ধ। গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই
জ্বালানাে হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এ গুড়ের কিছু অংশ তাপালের এক
পাশে নিয়ে বিশেষভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়ে ঘষতে হয়। ঘষতে ঘষতে এই অংশটুকু শক্ত হয়ে যায়।
এই শক্ত অংশকে বীজ বলে। বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। স্বল্পক্ষণের মধ্যে গুড় জমাট
বাঁধতে শুরু করে। তখন এই গুড় মাটির হাঁড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। গুড় জমাট বেঁধে পাত্রের
আকৃতি ধারণ করে। এই খেজুর গুড় যারা বানায়, তাদের ঐতিহ্যগত পরিচয় তারা গুড়-শিল্পী বা শিউলি। এই
শিউলিরা আদতে খেতমজুর। বর্ষার দিনে অনেক অঞ্চলে চাষাবাদের পর ভূমিহীন খেত মজুরদের কোনও কাজ
থাকে না। অনাহার-অর্ধাহারে তাদের দিন কাটাতে হয়। সেই সময় শিউলির দাদন নেয় মহাজনের কাছ থেকে
খেজুর গাছ। বিনিময়ে তারা মহাজনের নির্ধারিত দামে তাদের কাছেই অনেক সময় গুড় বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
খেজুর গুড় সারা বাংলাদেশেই পাওয়া যায়। খেজুর গাছ আরবের মেসােপটেমিয়াই আদি জন্মস্থান হিসেবে
বিবেচিত।এদেশে যেসব খেজুর চাষ হয় তার নাম Phoenix sylvestris এই খেজুর গাছের উচ্চতা ১০ থেকে
১৫ মিটার হয়ে থাকে। গ্রামবাংলার এই জাতটিকে বুনাে জাত হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।