এইচ আর রুবেল ,হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি : পালকী দিয়ে বিয়ে ছিল গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক। গ্রাম বাংলার যত লোকজ সামগ্রী আছে পালকী ছিল তার অন্যতম। গ্রামের মানুষ এই পালকীর সাহায্যে বিয়ে শাদী সম্পাদন করত এবং নাইয়রীরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেত। গ্রামে জমিদারী প্রথা চলাকালে জমিদারের ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, পুত্র, বউ সবাই পালকী ব্যবহার করত। গ্রামে রিকশা, ভ্যান, টেক্সি ইত্যাদি প্রচলন হওয়ার আগ পর্যন্ত মহিলাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল পালকী।
সুদূর অতীত থেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু এই বাংলা অঞ্চল। এখানে আগে বারো মাসে তের পার্বণ হতো।বছরের ছয়টি ঋতু পর্যায়ক্রমে বাংলাকে নব, নব সৌন্দর্যে বিভূষিত করে। বছরের ছয়টি ঋতু পনব সৌন্দর্যে বিভূষিত করে। শেষ তিন ঋতু গ্রামবাংলাকে আরো বেশি মনোমুগ্ধকর এবং আকর্ষণীয় করে তোলে। আগে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে হেমন্ত, শীত ও বসন্তকালে বিয়ে বেশি অনুষ্ঠিত হতো। গ্রামের মানুষরা বলত ‘দিনকাল আসলে আমি আমার ছেলে কিংবা মেয়েকে বিয়ে দিব’। অর্থাৎ শীতকালেই বিয়ের সাঁনাই বেশি বাজতো। এই বিয়ের অন্যতম বাহন ছিল পালকী। বর এবং কনেকে বিয়ের পর পালকী করে নিয়ে আসতো। সন্ধ্যার পর বরকে পালকী করে নিয়ে কনের বাড়ি যাওয়া হতো। সারারাত কনের বাড়িতে অতিবাহিত করার পর শেষ রাতে বিয়ে শেষ হলে পালকী করে বর এবং কনেকে বরের বাড়ি নিয়ে আসা হতো। একটি পালকিতে দুইজন কিংবা চারজন বেহারা থাকতো। দুই পালকীতে চারজন কিংবা আটজন বেহারা থাকতো। সামনে বরের পালকী এবং পেছনে কনের পালকী এগিয়ে যেত। কোন ক্রমেই বরের পালকীর আগে কনের পালকী যেতে পারতো না। সে সময় একটি ধারণা প্রচলিত ছিল যে, বরের পালকীর আগে কনের পালকী গেলে অমঙ্গল বা অকল্যাণ হবে।
বিয়ে বাড়িতে এখনকার দিনে যেসব খাওয়াদাওয়া হয় আগে গ্রামবাংলায় সে রকম ছিল না। আগে বর কনের বাড়িতে পা দিলে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিয়ের ঘরে বসানো হতো। ভাত খাওয়ার আগে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পিঠা, পুলি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। পিঠা বা নাস্তার পর্ব শেষ হলে পোলাও, কোরমা, মাছ, মাংস ইত্যাদি তৃপ্তি সহকারে খাওয়ানো হতো। এখন আর বিয়ে বাড়িতে গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী পিঠা, পুলি, পায়েস তেমন একটা থাকে না। যা কিছু খাওয়ানো হয় তা যেন কৃত্রিমভাবে তৈরি।
বিয়ে বাড়ির আগেকার দিনের সামাজিকতা এবং বর্তমান সামাজিকতার মধ্যে অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। পালকীর মতো অন্যান্য সামাজিকতা, আদর, আপ্যায়ন, স্নেহ, মায়া-মমতা ইত্যাদি সবই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিয়ে বাড়ির যানবাহন বলতে বুঝায় বর কয়টি গাড়ি, কার, মাইক্রোবাস, জিপ, ডিভিডি, ক্যাসেট, ভিডিও ইত্যাদি নিয়ে আসলো। আর আগেকার যানবাহন ছিল বর কনের বাড়িতে কয়টি হাতি, ঘোড়া, পালকী, নিয়ে আসলো তা বুঝাতো। বিয়ে বাড়ির যানবাহন হিসেবে হাতি, ঘোড়া, পালকী আজ বিলুপ্তির পথে। আমাদের নতুন প্রজন্ম পালকী কি কাজে ব্যবহার হতো তা হয়তো জানেই না? বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হিসেবে এটাকে টিকিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু যদি আমরা বাঙালিয়ানা ভুলে গিয়ে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মাঝে মিশে যাই তাহলে, বাংলা ও বাঙালির জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালকী।