পবিত্র রোজা ও রমজান– মাওলানা ইলিয়াছ আইযূবী ও এম,এইচ,রহমান :
আরবি রমাদ্বান অর্থাৎ রমজান বা রোজার মাস আরবি পঞ্জিকা অনুসারে এটি হিজরি সনের নবম মাস এবং শাবান মাসের পরেই এর স্থান। আরবি সকল মাসের শুরু এবং শেষ চাঁদ দেখার সাথে সম্পর্কিত বিধায় রমজান মাস কোনদিন শুরু হবে এবং এর মেয়াদ ২৯ দিন হবে নাকি ৩০ দিন হবে সেটা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সহিফা, তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল এবং কুরআনসহ সবকটি ধর্মীয়গ্রন্থ আরবি পঞ্জিকা অনুযায়ী রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে (মুসনাদে আহমদ, ইবনে কাসীর)।
মহান আল্লাহ তা’আলা সুরা বাকারায় ১৮৫ নং আয়াতে ঘোষণা করেন– “রমজান মাস যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে আর এ কোরআন মানব জাতির জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী”।
সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা’আলা এ মাসকে অন্যান্য সকল মাস থেকে ব্যতিক্রম এবং বিশেষভাবে বরকতময় করেছেন। ইসলামে সিয়াম সাধনা বা রোজাকে মুমিন মুসলমানদের উপর ফরজ করা হয়েছে। সিয়াম সাধনার ফলে মানুষের মনে খোদাভীতির সৃষ্টি হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ,লালসা ও রিপুর তাড়নায় বিপথগামী মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রেখে তাকওয়া ও আলোর পথ দেখায়।
ফজিলতপূর্ণ এ মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রথম দশদিন রহমত ও বরকতের জন্য দ্বিতীয় দশদিন মাগফিরাত এবং শেষের দিনগুলো নাজাতের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। রমজান মাসের ১টি রোজার গুরুত্ব এতই বেশি যে অন্য সময়ের সারা জীবন রোজা রাখলেও তা রমজানের ১টি রোজার সমান হবে না।
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে বান্দা তাঁর পানাহার এবং কামনা বাসনাকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে থাকেন, যার ফল স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা দেবেন। এছাড়া রোজাদারদের মর্যাদা এতই বেশি যে জান্নাতের আটটি দরজার মধ্য থেকে রাইয়্যান নামক দরজা দিয়ে শুধুমাত্র রোজাদারগণ ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
রোজা ব্যক্তির আচার, আচরণ ও চরিত্র সুন্দর করে এবং দেহমন পবিত্র হয়। এ মাসে আমলের সওয়াব অন্য মাস থেকে দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় এবং আল্লাহ চাইলে তা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। সিয়াম সাধনার ফলে মানুষের জীবনের গোনাহসমূহ মাফ করা হয় এবং রোজা আল্লাহ এবং বান্দার মাঝে সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য এক অদৃশ্য সেতু বন্ধন।
রোজা কেবল মুসলিম ধর্মগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিধানেই সীমাবদ্ধ নয়, ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বাইরে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই রোজার গুরুত্ব অনিস্বীকার্য বলে মনে করেন। মানুষের জীবনে সুস্থতা এবং কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য রোজা এক বিশাল নিয়ামত এবং এ নিয়ামত এতই বিশাল যে বিভিন্ন গবেষণায় তা বের হয়ে এসেছে।
বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে এসেছে যে, নিরোগ দেহ এবং কর্মক্ষম দীর্ঘজীবনের জন্য বছরের কতিপয় দিন উপবাস তথা রোজা রাখা অত্যাবশ্যক। রোজাদারদের উপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে যে- সিয়াম পালনের ফলে মানুষের শরীরে কোনো ক্ষতি হয় না বরং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এ পর্যায়ে ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবনে সুশৃঙ্খলা বজায় থাকে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ভারতের স্বাধীনতার জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) যিনি নিজে উপবাস পালন করতেন এবং ভক্তদের বলতেন- শরীরকে সতেজ ও সচল রাখার জন্য নূন্যতম খাবার এবং রোজা রাখা অতি উত্তম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী প্রফেসর মুর পাল্ড রোজার মূল্যায়ন এভাবে করেছেন যে- ইসলাম যদি স্বীয় অনুসারীদেরকে অন্য কোনো কিছু শিক্ষা না দিয়ে শুধুমাত্র এ রোজার ফর্মুলার বিষয়েই একটি শিক্ষাই দিত তবে এর থেকে উত্তম আর কোনো ইবাদত তাদের জন্য হতো না। হল্যান্ডের পাদ্রি ও গবেষক পোপ এলফ গাল তাঁর অনুসারীদেরকে মাসে অন্তত তিনটি করে রোজা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সিগমন্ড নারায়ান্ড তাঁর গবেষণায় মনস্তাত্তিক ও মস্তিস্ক রোগের জন্য রোজা বিশেষভাবে নিরাময়ী বলে প্রমাণ
করেছেন।
সিয়াম সাধনা ফরজ বিধান হলেও কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতা রয়েছে। বিশেষ করে গর্ভবর্তী নারীর রোজা পালন বাধ্যতামূলক নয় বরং এ ক্ষেত্রে রোজা পালনকে নিরুৎসাহীত করা হয়েছে এবং ঋতুবর্তী নারীদের জন্য রোজা রাখা নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া নারী পুরুষ নির্বিশেষে অসুস্থ ব্যক্তি, রোগী, মুসাফির ছাড়াও রোজা রাখার কারনে জীবন হুমকীর মুখে পড়লে সেক্ষেত্রে সিয়াম পালনের বিষয়ে ইসলামে শিখিলতা রয়েছে।
তবে বিনা কারনে বা ইচ্ছাপূর্বক রোজা ছেড়ে দেওয়ার পরিণাম ভয়াবহ যা আল্লাহর আদেশ অমান্য করার সামিল। আল্লাহর দেওয়া ফরজ বিধান সিয়াম পালন জান্নাতের আমন্ত্রণ এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল এবং পার্থিব জীবনে ভালো থাকার বিষয়ে সুস্পষ্ট পথনির্দেশিকা রয়েছে বিধায় প্রত্যেক নরনারীর জন্য সিয়াম পালন কল্যাণকর এবং অতি উত্তম সুব্যবস্থা।