মাওলানা ইলিয়াছ আইয়ূবী ও এম এইচ রহমান :
শব শব্দটি ফারসি যার আরবি অর্থ লাইলাতুন এবং বাংলায় এর অর্থ হলো রাত বা রজনী। কদর শব্দের অর্থ মহিমান্বিত, মর্যাদা বা সম্মানিত। অর্থাৎ শব-ই-কদর বা লাইতুল কদর এর বাংলা অর্থ মহিমান্বিত রজনী বা সম্মানিত রাত্রি বা মর্যাদার রাত।
লাইলাতুল কদরের প্রেক্ষাপটঃ কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা মতে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এর পুর্ববর্তী সময়ের নবীগণের উম্মতেরা দীর্ঘজীবন লাভ করতেন ফলে তাঁরা বেশি বেশি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর ইবাদত বন্দেগী করার সুযোগ পেতেন।
ইবনে আবি হাতেম (রাঃ) এর বর্ণনা মতে মহানবী (সাঃ) একবার বনি ইসরাইলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করেন, সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম এবাদতে মশগুল ছিল। এ কথা শুনে
উপস্থিত সাহাবিগণ বিস্মিত হয়ে বলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ আমদের হায়াত কম, আমরাতো তাঁদের মতো এত বেশি ইবাদত করার সুযোগ পাব না। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশেষ নেয়ামত হিসাবে এ রাত নাজিল করেন এবং মহানবী (সাঃ) উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কদরের রাতের ফজিলত বর্ণনা করে ৫টি আয়াত
বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ সুরাও নাজিল করেন, যে সুরাটি ‘লাইলাতুল কদর’ নামে পরিচিত। এ সুরায় মহান আল্লাহ বলেন– ‘নিশ্চয় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এ রাতে’ (সুরা কদর আয়াত-১)
এবং এ রাতের গুরুত্ব বোঝাতে মহান আল্লাহ বলেন– ‘মহান্বিত এ রজনী হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’(সুরা কদর আয়াত-৩)।
কদরের রাতের সময়কালঃ প্রকৃত অর্থে লাইলাতুল কদর বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন রাত স্থির করা হয়নি এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনও নির্দিষ্ট করে কদরের রাত কবে সেটাও বলেননি ।
লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করিম(সাঃ) বলেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে ইসলামের স্বীকৃত চার মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিযী হাদিসে বর্ণিত হযরত আয়েশা(রাঃ) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত গুলোর মধ্যে কদরের রাতকে খোঁজ কর”। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এরই প্রমাণ পাওয়া যায়।
অবশ্য কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদ বিভিন্ন গবেষণা ও গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ২৬ রোজার
দিবাগত রাতকে লাইলাতুল কদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন।
কদরের রাতের বৈশিষ্ট্য :
এ রাতের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এ বিষয়ে হাদীসে বর্ণিত আছে- রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। হালকা মৃদু বাতাস প্রবাহিত হবে, রাতের তাপমাত্রা খুব বেশি গরম বা ঠন্ডা হবে না এবং রাত শেষ হলে পূর্ণিমার চাঁদের মতো হালকা আলোক রশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে।
এ রাতের মহিমা ও স্থায়ীত্বকাল সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা কদরের ৫ নং আয়াতে বলেন- ‘শান্তিই শান্তি, সে রজনী ঊষার অবির্ভাব পর্যন্ত’।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্বঃ লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বোঝাতে মহান আল্লাহ বলেন ‘ আমি তো ইহা (কুরআন) অবতীর্ণ করিয়াছি এক মুবারক রজনীতে, আমিতো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয় (সুরা আদ দোখান, আয়াত-৩ ও ৪)।
পরবর্তী ২৩ বছরে বিভিন্ন ঘটনা বা অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সুরা বা সুরার অংশবিশেষ রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামে’র উপর অবতীর্ণ হয়। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেন– যে ব্যক্তি এ রাতে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে আল্লাহ তাঁর পূর্বেকার সকল গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। (বুখারী)
এ রাতে ফেরেশতাগণ ইবাদতরত বান্দাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তির বাণী শোনায়। হাজার মাসের ইবাদতের থেকেও উত্তম এ রাতে যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় নফল নামজ আদায় করবে আল্লাহ সে সকল মুমিন বান্দার পূর্বেকার সকল গোনাহসমূহ মাফ করে দেবেন। এক কথায় শব-ই-কদরের এ রাতেকে শান্তি বর্ষণের রাত বলা হয়।
হযরত আনাস ইবনে মালিক(রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেল আর সে তার জীবনের গুনাসমূহকে ক্ষমা করাতে পারলো না তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে
আর কেউই নেই’।
রজঃস্রাবের সময়ে নারীদের নামাজ ও রোজা পালন নিষেধ বিধায় এ সময়ে তাঁরা ইবাদতের সময় হলে ওযু করে জায়নামাজ বিছিয়ে বিভিন্ন দোয়া দরুদ পাঠ করবেন, বেশি বেশি কালিমার সর্বোত্তম তাসবিহ পাঠকরবেন এবং আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ইসতেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এতে তিনি সম্পাদিত আমলের ও সময় নির্ধারিত আমলের সওয়াব লাভ করবেন। সুরা আল আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ̄ষ্পষ্টত উল্লেখ করেছেন– “অধিক ̄স্মরণকারী পুরুষ এবং অধিক স্মরণকারী নারী-ইহাদের জন্য ̈ আল্লাহ রাখিয়াছেন ক্ষমা ও মহা-প্রতিদান(অংশ)”।
কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাত ছাড়া হয়ে না যায় সেজন্য এ দশদিন পুরো সময়টাতে মহানবী (সাঃ) এতেকাফরত থাকতেন।
সে কারনে শুধুমাত্র ২৬ শে রমজানের দিবাগত রাতের জন্য অপেক্ষা না করে আমদেরও রমজানের শেষ দশ দিনে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করা উচিত। লাইলাতুল কদরের ফজীলতপূর্ণ এ রাতকে খুঁজে পেতে আল্লাহ পাকের দরবারে পূর্ণ মাত্রায় সমর্পণ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়াটাই হবে উত্তম।